Blog

Post Thumbnail

নাহিদ যেভাবে বাংলাদেশের ছাত্র বিপ্লবের মুখ হয়ে উঠলেন

September 29, 2024 by Shahriar Ahmed Shovon

TIME এ দেয়া নাহিদ ইসলামের সাক্ষাৎকার আমি বাংলায় অনুবাদ করেছি,

বছর দুয়েক আগে নাহিদ ইসলাম ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছেন। বাংলাদেশের কোন ছাত্র আন্দোলন কেন তার কাঙ্ক্ষিত চুড়ায় পৌঁছাতে পারেনা তার কারণ অনুসন্ধান ছিল ইসলামের থিসিসের বিষয়। থিসিসের উপসংহার কী ছিল সেটা মনে আছে নাকি নেই তা এই মুহূর্তে কোনো বড় ব্যাপার না। ২৬ বছর বয়সের এই যুবক ইতোমধ্যে ইতিহাস পাল্টে দিয়েছেন।

একসময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী হিসেবে বিবেচিত, স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার যে বিশাল আন্দোলন সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল ইসলাম ছিল সেই আন্দোলনের অন্যতম পরিচিত মুখ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রালয়ের ঢাকার অফিসে রাজকীয় কাঠের প্যানেলের রুচিশীল অফিসে কালো লেদারের চেয়ারে বসে, এই রবিবারে ইসলাম TIME কে বলেন, “হাসিনা একজন রক্তপিপাসু এবং সাইকোপ্যাথ।”

নাহিদ ইসলাম তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ের শিক্ষকতাও করেছেন। সরকারের হাত থেকে গ্রেফতার এড়াতে ইসলামের পালিয়ে বেড়ানোর ঘটনা বেশি দিনের নয়। আর আজকে তিনি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রালয়ের মন্ত্রী।

এই জুনে হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্ল্যাকার্ড হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে গিয়ে সবাইকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান নাহিদ ইসলাম। সেসময় পুর্বে সমালোচনার কারণে বাতিল করা কোটা ব্যবস্থাকে নতুন করে চালু করার আদেশ দেয় উচ্চ আদালত। যে কোটা ব্যবস্থায় ‘৭১ এর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দিত। ইসলাম এবং তার সহপাঠিরা বৈষম্যহীনভাবে সকলের জন্য চাকরির সমান সুযোগের দাবি জানান।

কোটা কেন্দ্রিক আন্দোলন সর্বপ্রথম ২০১৮ সালে দেশব্যাপী বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শুরু হয়। তখন সরকার পিছু হটে দাবি মানতে বাধ্য হয় এবং আন্দোলন তখনই শেষ হয়। এবছরেও ঠিক সেভাবেই এই আন্দোলন শেষ হতে পারতো বলে মন্তব্য করেন নাহিদ ইসলাম। কিন্তু এবারে আন্দোলনকারীদের দিকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গুলি করতে শুরু করে। ১৬ই জুলাই, আবু সাঈদ, আরেকজন ছাত্র নেতা যিনি দুই হাত প্রসারিত করে খালি হাতে পুলিশের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন এবং তখন পুলিশ গুলি করে তাকে হত্যা করে।

নাহিদ ইসলাম বলেন, “আবু সাঈদের হত্যাই ছিল পুরো আন্দোলনের গেম-চেঞ্জিং মোমেন্ট।” এরপরেই দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী খুব দ্রুত এই আন্দোলনে জড়িয়ে যায়। দুর্নীতিবাজ সরকারের প্রতি মানুষের পাহাড় সমান ক্ষোভ, নিত্যপন্যের আকাশচুম্বী দাম, এবং আস্তে আস্তে স্বৈরাচার সরকারের কঠোর নীতির কারণে সাধারণ মানুষ আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ত করে ফেলে। সময়ের পরিক্রমায় আন্দোলনকারীরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে দৃষ্টি দেয়। আগস্টের ৩ তারিখে আন্দোলনকারীরা এক দফা নিয়ে হাজির হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নাহিদই ঘোষণা করেন, শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে শেখ হাসিনা বাধ্য হয়, আগস্টের 5 তারিখে লাখো মানুষ ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে তার বাসভবন ঘেরাও করতে উদ্যত হলে।

চেয়ারে সামনে পেছনে দুলতে দুলতে নাহিদ বলেন, “কেউ কখনো ভাবেনাই হাসিনাকে সরানো যাবে।”

আর্মির সমর্থনে শিক্ষার্থীরা ১৭ কোটি জনসংখ্যার দায়িত্ব হাতে পেয়ে ৮৪ বছর বয়সী শান্তিতে নোবেলজয়ী মোহাম্মদ ইউনুসকে অন্তরবর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করে। ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের মাধ্যমে উৎপাদন শিল্পে বিপ্লব এনে দিয়ে পরিচিতি পাওয়া এই অর্থনীতিবিদ নিজেও হাসিনা সরকারের দ্বারা একের পর এক মামলায় জর্জরিত হয়ে নির্বাসিত ছিলেন। দায়িত্ব নেয়ার পরে তিনি মামলার জট থেকে মুক্ত হয়েছেন।

শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের চাওয়া থেকেই অন্তরবর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ইউনুস এখন ইসলামের বস। কে কার থেকে অর্ডার নেয় জিজ্ঞেস করাতে ইসলাম হেঁসে বলেন, “ইউনুস মূলত আমাদের সব বড় বড় সিদ্ধান্তে পরামর্শ দেন।”

ডেস্কের একটা লাল টেলিফোনের তার দেখিয়ে ইসলাম বলেন, “VIP ফোন।” কিছুটা নিজেকে প্রসারিত করে ইসলাম বলেন, “জানিনা আমার আসলে কী কাজে এইটা ইউজ করা উচিত। আমি ইউনুসকে হোয়াটস্যাপেই টেক্সট করি।”

নাহিদ ইসলামের জীবনে গত কয়েক সপ্তাহে হয়ে যাওয়া সবকিছু নিয়ে যদি সে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেও তবুও তার নির্বিকার হাবভাব দেখে তা বোঝার উপায় নেই। তার থেকে বয়সে বড় বেশ দক্ষ একজন ব্যক্তিগত সহকারী বিভিন্ন নথিপত্র হাতে সাইন করানোর জন্য তাড়াহুড়োর সাথে রুমে আসা যাওয়া করছিলেন। তার দুইটা মোবাইল ফোন একের পর এক বেজেই চলেছে। এছাড়া ইসলামের বাসভবনেও ভোর অবধি মানুষের যাতায়াত চলতেই আছে। ঝাঁড়বাতি দিয়ে সজ্জিত এবং সাদা সোফার ইসলামের বর্তমান শোবার ঘর তার আগের পুরো এপার্ট্মেন্টের আয়তনের সমান বড়। একপ্রকার অপ্রত্যাশিত ভাবেই ঢাকার এই আলিসান ভবনে ইসলামের বাস।

সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক করা নাহিদ সবসময়ই সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া মানুষের মধ্যে থাকতেন। ঢাকায় বেড়ে ওঠা, স্থানীয় একজন শিক্ষকের সন্তান, যিনি ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই প্রথম সপ্তাহে সুন্দরবনের গা ঘেঁষে স্থাপন হতে যাওয়া কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধিতা করে আন্দোলনে অংশ নেন। ২০১৯ সালে ইসলাম ক্যাম্পাসের নির্বাচনে অংশ নেন এবং সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি নামের সংগঠন শুরু করেন।

তবে বেশিরভাগ মানুষের কাছে তিনি পরিচিতি পান এবছরের জুলাইয়ে যখন সরকারের সমালোচকদের গুম করে দেয়ার জন্য কুখ্যাত হওয়া গোয়েন্দা সংস্থার হাতে তিনি নির্যাতনের শিকার হন। এক অত্যাধিক গরমের রাতে, ৩০ জন সাদাপোশাকের অফিসার আসে তার বন্ধুর বাসায়। যেখানে ইসলাম আন্দোলনের অংশ নেয়ার কারণে গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে ছিল। নাহিদ বলেন লোকগুলো তার মাথায় কালো কাপড় পড়িয়ে দেয় এবং বলে, “এই দুনিয়া আর কোনদিন তোকে দেখবেনা।”

ইসলামের ভাষ্যমতে গোপন বন্দিশালায় নিয়ে তাকে লোহার রড দিয়ে মেরে হাত এবং পায়ে কালশিটে দাগ ফেলে দেয়। চোখে জোরালো আলো দেয়া, অসহ্যকর শব্দ, আর একের পর এক আঘাতের ব্যথায় মাথা ঘুরতে থাকে এবং বারংবার অজ্ঞান হয়, জ্ঞান ফেরে।

নাহিদ বলেন তারা জিজ্ঞেস করতে থাকে, “মাস্টারমাইন্ড কে? টাকা আসছে কোথা থেকে?” এর একদিন পরেই তাকে একটা ব্রিজের পাশে ফেলে রেখে যায়। নাহিদ আরো বলেন, “গোয়েন্দা সংস্থারা মূলত পরিচিত মুখ খুঁজছিল, আন্দোলনের নেতা হিসেবে। কিন্তু আমাদের সেরকম কেউ ছিলনা। আর এটাই আমাদের মূল শক্তি ছিল।” মন্ত্রালয়ে নিজের অবস্থানে বেশ আত্মবিশ্বাসী ইসলাম জোড় দিয়েই বলেন যে আন্দোলন চালিয়ে নেয়া ছিল মূলত সম্মিলিত প্রচেষ্টা। আরো বলেন, “মিডিয়া সবসময় একটা মুখ চায় নেতা হিসেবে, কিন্তু আমি একা এই আন্দোলনের নেতা নই। এখানে আরো অনেকে ছিল।”

হাসিনার সরকারের পতনের পরে, ক্ষমতার শূন্যস্থান খুব দ্রুত পূরণের প্রয়োজন ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. সামিনা লূৎফা বলেন অন্তরবর্তীকালিন সরকার ঘোষণার দিন তিনি ইসলামকে বেশ নার্ভাস খেয়াল করেন। তিনি যোগ করেন, “সে এখনো অনেক ছোট। এটা তার জন্য বিশাল এক দায়িত্ব।”

আন্দোলন পরবর্তী অবস্থায় অন্তরবর্তীকালিন সরকারের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা হয়ে ওঠে আকাশচুম্বী। নতুন বাংলাদেশে সবাই ছাত্রদের থেকে শুধুমাত্র ভালোটাই আশা করছে। এই ছাত্ররাই স্বৈরাচার থেকে মুক্ত হতে মানুষকে পথ দেখিয়েছিল এবং এখন অনেকেই খোলাখুলি স্বৈরাচার বলার সাহস করছে।

নাহিদ ইসলামের ফোন আবার বাজছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে একজন শিক্ষার্থীর চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী ডাক্তারদের উপর আক্রমণ করেছে। ডাক্তাররা এই ঘটনায় প্রতিবাদ করে কর্মবিরতিতে আছে। ইসলামকে এই ঘটনায় মধ্যস্থতা করতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেতে খেতে আরেকটা ফোন। সরকারী চাকুরীর দাবিতে আন্দোলনরত কয়েকজন, মোহাম্মদ ইউনুসের অফিস ইউনুসের নাম্বার দিতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করছে।

ইসলাম বলেন, “খুব অদ্ভুত।” আন্দোলনকারীদের দিকে নির্দেশ করে বলেন, “এক সময় আমরা ওদের জায়গায় ছিলাম। আর আজকে আমাদের ওদেরকে ম্যানেজ করতে হচ্ছে।”

ভয়ের সংস্কৃতি, সমালোচকদের প্রতি কঠোর দমন-পীড়ন, ভোট ছিনতাই করে ১৫ বছর ধরে টিকে থাকা শাসনের অবসান ঘটিয়ে মানুষ তাদের আওয়াজ তুলতে পেরে অনেক উজ্জীবিত। মানুষ এখন তাদের নতুন স্বাধীনতার অবাধ ব্যবহার করছে। নারীরা তাদের নির্যাতনের মামলা করছে। অনিয়মিত ক্লাসের কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের পরীক্ষা পেছানোর জন্য বলছে। এমনকি ঢাকার উচ্চবিত্ত শ্রেণির স্কুলের শিক্ষার্থীদেরও বিক্ষোভ-প্রতিবাদে দেখা গেছে কারণ তারা তাদের প্রিন্সিপালকে পছন্দ করেনা।

ইসলাম বলেন, “গত ১৫ বছর ধরে মানুষ কথা বলতে পারেনি। শেষপর্যন্ত তারা একটা সুযোগ পেয়েছে।”

কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখনো তার সামনে। যদিও সাধারণ দৃষ্টিতে দেশের মধ্যে একটা স্বস্তির চিত্র দেখা যাচ্ছে, তবুও খুব বেশি উদযাপনের সুযোগ নেই। এখনো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা এই সরকারের প্রধান চিন্তা। এছাড়াও একটা বড় ভয় আছে যে সেনাবাহিনী বা বিতাড়িত হওয়া আওয়ামী লীগ জোড় করে ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা করতে পারে। হলেও সেটা বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোন ঘটনা হবেনা, ঐতিহ্যগতভাবেই এদেশের রাজনীতি সহিংসতাপুর্ণ।

ইসলাম বলেন অন্তরবর্তীকালিন সরকারের মূল কাজ দেশের দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন করা এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া অবধি দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনা। আরো যোগ করেন, “আমরা খুব কম সময়ের জন্য এখানে।” তিনি আরো বলেন, “মানুষ আর এইসব দুর্নীতি, সহিংসতা চায়না। আমাদের এখন নতুন প্রজন্মের পালস বুঝতে হবে। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।”