Blog

Post Thumbnail

ডাইয়েরির পাতায় জুলাইঃ ১৫-৩৬

October 23, 2024 by Shahriar Ahmed Shovon

১৫ই জুলাই, ২০২৪

ক্লাস শেষে রুমে এসে সায়েমের সঙ্গে টেলিগ্রামে কিছুক্ষণ কথা বললাম র‍্যান্ডোম টপিক নিয়ে। এরপরে সন্ধ্যা ৭:৩০ এর আশেপাশে সায়েম হুট করে একটা টেলিগ্রাম গ্রুপ আর ফেসবুক গ্রুপের লিংক দিলো, “ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন”। দুইজন গতকালকেও মেইবি আলাপ করতেছিলাম যে পাবলিকে না পড়ার আক্ষেপ তেমন জাগেনা বাট এই আন্দোলনে যখন দেখি ছাত্রলীগ এসে হামলা করে আর সবাই প্রতিবাদ করে তখন আক্ষেপ হয় কেন আমি ঢাবির না। সায়েমের দেয়া লিংকে ঢুকে দেখি ৮ টায় সবাই আন্দোলনে বের হবে হল-১ এর সামনে আসতে বলেছে। রুম থেকে আবির আর মঞ্জুরুলও যেতে চাইলো। একসঙ্গে রুমের আমরা + সায়েম আর ওর রুমমেট গেলাম সবাই। গিয়ে দোকান থেকে পোস্টার পেপার কিনে কিছু লিখে পোস্টার নিয়ে মিছিলে গেলাম। পোস্টার থাকায় আমি একদম সামনের দিকে ছিলাম। সঙ্গে সবাই ছিল। মিছিল বেশ বড়সড় হয়ে ওঠে আস্তে ধীরে। ১০ টার কিছু পরে মিছিল শেষ করে ঘরে ফিরলাম সবাই।

রাত ২-৩ টার দিকে ফিক্সড হইলো পরেরদিন মঙ্গলবার আমরা সবাই বিরুলিয়া ব্রিজ যাবো যেখানে আশেপাশের আরো ইউনিভার্সিটি মানে মানারাত, সিটি, ইস্টার্ন এরাও থাকবে। তবে আমাদের ভার্সিটির অনেকেই যাবেনা বা এরকম তৎপরতা দেখাচ্ছিল। তাই মনে হলো এদের আশায় থাকা ঠিক হবেনা।

এর মধ্যে ব্র্যাকের ফাহিম ভাই-কে নক করে জানলাম উনাদের ১৬ তারিখের মিছিলে আমি যেতে পারবো কিনা। উনি বললেন যেতে পারবো সমস্যা হওয়ার কথা না। পরে উনি জানাবেন বলেছেন এই বিষয়ে। আমি, এশা, সায়েম, রিয়াদ, আসির প্ল্যান করলাম আমরা ১৬ তারিখ প্রথমে বিরুলিয়া ব্রিজে যাবো। গিয়ে যদি দেখি যথেষ্ট বড় মিছিল আমরা জয়েন করবো নাহলে ব্র্যাকের সঙ্গে যুক্ত হবো।

১৬ই জুলাই, ২০২৪

সকালে আমি সায়েম, এশা, আসির বনমায়া গিয়ে বসে পোস্টার বানাচ্ছিলাম। ওয়েল, মূলত এশাই বানাচ্ছিল আমরা বসে ছিলাম। পরে রিয়াদ এসে জয়েন হয়। অনেক ঝামেলা করে বিরুলিয়া গিয়ে দেখি বেশ অনেকেই আছে সেখানে। আবার আগেরদিনের মতো আমি, সায়েম, এশা, আসির, রিয়াদ সবার কাছে পোস্টার ছিল দেখে আমরা সামনে ছিলাম। মাঝে রিয়াদ আর সায়েম বললো আমাদের ভার্সিটির কেউ তো সামনে স্লোগানে নাই ব্যাপারটা খুব লজ্জার। এত বড় ভার্সিটি অথচ বেশিরভাগ কাপুরুষ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেতে পারেনা।

আমার চেহারা বেশ বড়দের মতো। গেলাম সামনে, গিয়ে সুযোগ মতো স্লোগানের দায়িত্ব নিয়ে স্লোগান দিতে শুরু করি। প্রথমে ঠিক থাকলেও পরে ফ্লোতে গিয়ে ভুলভাল স্লোগান দিয়ে পরে অফ যাই। যদিও প্ল্যান ছিল ৩ টা অব্ধি বাট ঝামেলার ব্যাপারে আঁচ পেয়ে বড় ভাইয়েরা সব প্ল্যান করলো ১:৩০ এর দিকে আমরা ফিরে যেতে শুরু করবো। যেহেতু আমাদের সংখ্যা হয়তো ৫০০’র বেশি ছিলনা আর তখন কেউ আক্রমন করলে আমাদের ব্যাকআপও ছিলনা।

ওখানে অবস্থান শেষে মিছিল নিয়ে ফিরতে শুরু করলাম। মিছিলে অনেকবার স্লোগান দিয়েছি আমি, প্রথমবারের মতো আর ভুল করিনি। বেশ ভালোরকম স্লোগান দিতে পেরেছি। এই মিছিলে স্লোগান দেয়ার সময় পরিচয় হয় শাকিল ভাইয়ের সাথে, মানারাতের। শাকিল ভাই বলেন তোমার ভয়েস স্ট্রং এই বলে সামনে নিয়ে বলেন স্লোগান দিতে। ( এই শাকিলভাইকেই পরে উত্তরায় থানার সামনে কুত্তার বাচ্চা পুলিশ চোখের সামনে গুলি করে শহিদ করে দিয়েছে। ) স্লোগান দেয়ার পরে গলার অবস্থা প্রচণ্ড বাজে। একদম কথা বলতে পারছিনা এরকম অবস্থা। ভার্সিটি ফিরলাম তখন ৩ টা মতো বাজে। আবিররা বিরুলিয়া গেছিল না, আবির সেজন্য ফোন দিয়ে বললো ও জাহাঙ্গীরনগর যাচ্ছে অন্যদের সাথে। আমি বললাম আমি খুব ক্লান্ত আর যেতে পারবো না। টায়ার্ড শরীর নিয়ে এসে চুপ করে বসে ফেসবুক ব্রাউজ করছিলাম। ওইদিন আবিররা চলে আসছিল জাবি'র ভাইদের রিকুয়েস্টে এন্ড এরপরে জাবিতে অনেক মারামারি হয়। জাবিতে হলে ফিরোজ থাকে ওর সঙ্গে মাঝেমধ্যেই ফোনে সিচুয়েশন নিয়ে আপডেট নিচ্ছিলাম।

এইদিন ব্র্যাক সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা করে ছাত্রলীগ। রাতে দেখলাম দেশের সব ভার্সিটি সহ সব প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। সায়েম ফ্যামিলির ইস্যুর কারণে বাসায় যেতে চাইলো। ওর আব্বু আম্মু তখন সিরিয়াস অসুস্থতার কারণে ভারতে। এছাড়া বিরুলিয়া থেকে এসে ভালোরকম টেন্সড ছিলাম কারণ গলায় আমার আইডি কার্ড ছিল সামনে থেকে স্লোগান দিছি। তো আন্দোলনের লিড ধরে ভার্সিটি থেকে রাস্ট্রিকেট করা অসম্ভব কিছুনা। সায়েমও এই ভয়ে ছিল। পরে যদিও মনে হয় এমন কিছু হবেনা। তাছাড়া মুখে দাঁড়ি ছিল, শিবির বলে ধরলে কেউ একচুয়ালি আটকাতে আসতো না।

১৭ই জুলাই, ২০২৪

ঘুম থেকে উঠে প্ল্যান ছিল আজকে ঢাবি যাবো। ওখানে বিকেলে গায়েবানা জানাজা হবে সেখানে। সঙ্গে যাওয়ার মতো কেউ ছিলনা আসলে। শাফি ছিল মোহাম্মদপুরে, ফোন দিলাম যে ও কখন যাবে। ওর সঙ্গে কথা বলে রেডি হলাম বের হবার জন্য। কিন্তু সত্যি বলতে ভেতরে একটা ভয় কাজ করছিল কারণ আমি ছিলাম একা। সঙ্গে যাওয়ার মতো কেউ ছিলনা।

ভাবলাম এমন তো হবেনা যে আমার মারা যাওয়ার কথা ১০ দিন পরে কিন্তু ওরা আমাকে আজকে মেরে ফেলবে। আল্লাহ যেদিন ফিক্সড রাখছেন ওইদিনই মরবো। যা হবার হবে ভাবার টাইম নাই, যাই।

বের হয়ে পড়েছি প্রায়, স্যান্ডেল পড়ব। এশা বারবার ফোন দিয়ে নিষেধ করলো যেতে কারণ ও আপডেট নিছে যে একা গেলে ঝামেলা হবে তাছাড়া পুলিশ ঢুকতে দিচ্ছেনা। সাহস সত্ত্বেও একটা আশংকা কাজ করছিল মনের মধ্যে। পরে কনফার্ম হতে শাফিকে ফোন দিলাম যে ঢাবিতে নাকি ঢুকতে দিচ্ছেনা। শাফি জানালো ও ঢাবিতে গেছিল কিন্তু আইডি কার্ড না থাকায় পুলিশ কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেনা। গেটের ওখানেই নাকি আটকায়ে দিচ্ছে।

তাই বাধ্য শেষ অবধি ভাবলাম ক্যাম্পাসেই জানাজা পড়ি। জোহর শেষে নানা ঝামেলার কারণে পোলাপান নিয়ে আর পড়া হলোনা জানাজা। কিছুটা ক্ষোভ নিয়েই ফিরলাম রুমে। তারপরে ফেসবুকে এখানে মারা যাওয়ার খবর ওখানে আহত এসব দেখে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। পরে বিকেলের দিকে শুনলাম মঞ্জুরুল আন্দোলনে গেছে ভার্সিটির পোলাপানের সঙ্গে C&B তে। সেখানে নাকি বেশ ভালো মারামারি হয়েছে। এসব শুনে আমি যাওয়াদ আর আবির গেলাম। গিয়ে দেখি পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে। কয়েকজন ভাই একটু গুলি খেয়ে আহত ছাড়া তেমন সিরিয়াস কিছু হয়নি। রাতে ফিরলাম সেখান থেকে। রাস্তার মধ্যে ইফতার করি পানি দিয়ে, সারদিন রোজায় ছিলাম আশুরার। লাইফে ফার্স্ট টাইম আশুরার রোজা করছি। ইফতারের আগে এই স্বৈরাচারী ফেরাউনের জন্য যেসব দোয়া করছি আল্লাহ একটা দোয়া কবুল করলেও দেশের মানুষ স্বাধীন হয়ে যাবে।

১৮ই জুলাই, ২০২৪

কোনমতে রাতটা নানা টেনশনে পার করে পরেরদিন ফেসবুকে এশাদের গ্রুপে পোস্ট, কমেন্ট আর এখানে ওখানে আপডেট চেক করছিলাম। ১১ টার দিকে রিয়াদ ফোন দিয়ে বললো উত্তরার অবস্থা খুব বাজে এন্ড ও ওখানেই আছে। আমি যাওয়াদ আর আবির বের হয়ে পড়লাম খুব দ্রুত। ওখানে বারবার টিয়ারশেল মারছিল তাই রিয়াদ বললো যাওয়ার সময় যেন পানি, পেস্ট আর লেবু নিয়ে যাই। বের হয়ে এসব নিয়ে যখন উত্তরা হাউস-বিল্ডিং পৌঁছেছি তখন বাজে ১:১৫ মতো। আরো আগে পৌছানো যেতো কিন্তু রাস্তায় অটো রিক্সা পাওয়া যাচ্ছিল না।

ওখান থেকে রিয়াদেকে সঙ্গে নিয়ে BSN এর দিকে যেতে শুরু করি। রাস্তার মধ্যে পুলিশের সঙ্গে কয়েকবার ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া হয়। এন্ড জীবনে প্রথমবারে মতো টিয়ারশেল খাই। জিনিসটা এতোটা পেইনফুল ধারনাও ছিলনা। নিশ্বাস অফ হয়ে যাওয়ার মতো হয় + চোখ মুখন নাক জ্বলে যায়। আল্লাহ বাচাইছে পেস্ট আনছিলাম। পেস্ট লাগায়ে আর আগুনের কাছে গিয়ে ঠিক হই। এরকম ২-৩ বার হওয়ার পরে আমরা সামনে আরো এগিয়ে যাই। আমরা অল্প অল্প আগাচ্ছিলাম আর আশেপাশের টিন, বাঁশ খুলে এনে আগুন ধরায়ে রাখছিলাম রাস্তার মধ্যে। জায়গা দখল করে না রাখলে আস্তে ধীরে আমরা শুধু পেছনেই যেতে থাকবো এমন হয়ে যেতো। রিয়াদ আসছিল সকাল থেকে তাই ও অনেক টায়ার্ড ফিল করছিল আর বাসা থেকে বারবার ফোন পাওয়াতে রিয়াদ ফিরে যায় বাসায়। তখন ছিলাম আমি জাওয়াদ আর আবির।

ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলতে চলতে একসময় আমরা পুলিশকে পেছাইতে পেছাইতে থানার সামনে নিয়ে চলে গেছি। পুলিশ সবাই একসঙ্গে গুলি করে এরপরে যেই একটু থামে ( রিলোডের জন্য মেইবি ) আর আমরা দৌড়ে চলে যাই ইট বাঁশ হাতে করে। এইরকম প্রসেস বারবার চলতে থাকে আর আমরা ওদের পেছাতে থাকি। কিছুক্ষণ পরে চারিদিক থেকে সবাই মিলে থানা ঘিরে ফেলি। পুলিশ থানার সামনে আমাদের থেকে মাত্র ২ হাত দূরে। পোলাপান সব খেপে আছে আর পুলিশকে সরে যেতে বলছে। কারণ আমাদের টার্গেট ছিল উত্তরার এই ইম্পরট্যান্ট রোড ব্লক করে রাখা। এই টার্গেট সফল করতে পারলেই হলো। কিন্তু পুলিশ সেখানে কোনো আগে থেকে উসকানি ছাড়াই গুলি করে বাঁধা দেয়। যদিও এতক্ষণ অবধি রাবার বুলেট আর টিয়ারগ্যাসেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাট শেষ অবধি আমরা সিদ্ধান্ত নেই পুলিশের সঙ্গে ক্যাচাল করা ঠিক হবেনা। কারণ দূরেই র‍্যাবের গাড়ি সহ ব্যাকআপ ছিল। সামনে মানারাত সহ অন্যান্য কয়েকজন ভাই মিলে আমাদের বসতে বলছিলেন কারণ পুলিশ যখন দেখেছে আর উপায় নাই তখন আলোচনা করতে রাজি হয় এবং তারা চলে যাবে টাইপ কথা বলে।

আমাদের সঙ্গে ভালো কথা বলে আলোচনার কথা বলে বসতে বলে। বেশিরভাগ সবাই বসে পড়ে। আমি বসে পড়লে আবীর বসতে নিষেধ করে কারণ যদি ধাওয়া দেয় তখন বসা থেকে উঠে দৌড়ানোর মতো অবস্থা থাকবেনা। এরপরে এই কথা বলতে বলতে কোনো কথা নাই বার্তা নাই হুট করে ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে সামনের সারির ভাইদের পেটে কুত্তার বাচ্চা পুলিশের দল গুলি চালায়। অথচ যাদের গুলি করছে তারাই মূলত আমাদের থামায়ে পুলিশের সঙ্গে আলোচনা করে ফিক্স করবে এই কথা বোঝাচ্ছিল। বেশিরভাগ পোলাপান পুলিশের সঙ্গে আলোচনায় রাজি ছিলনা সবাই খেপে আছে ধরে মারবে। এন্ড ঐখানে কয়েকহাজার পোলাপান থানা ঘিরে রাখছে। চাইলে সত্যি বলতে ঐ কয়েকশ পুলিশ ওখানেই শেষ করে দিতে পারতো সবাই। কিন্তু আমরা তো খুনি না, আমাদের প্ল্যান ছিল শুধু রাস্তা অবরোধ করা। তাই এধরনের কিছু কেউ চাইনি। আর সামনের ভাইরাও আটাকাচ্ছিলেন যেন কেউ উত্তেজিত না হয়। অথচ ওদেরকেই পুলিশ ডাইরেক্ট গুলি করলো। ওখানেই মানারাতের শাকিল ভাই শহীদ হন। যিনি এর আগে বিরুলিয়াতেও আমাদের সঙ্গে আন্দোলনে ছিলেন। আমার সঙ্গে হাত ধরে স্লোগান দিছেন একদম সামনে থেকে। পরিচয় হয়ে গেছিল বলা চলে।

পরে আমরা সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। আমি আর আবির চলে গেছি তখন থানার সামনের দিকে গলি দিয়ে। ক্রিসেন্ট হাসপাতালের ওই রোডে। আর যাওয়াদ তখনো পেছনে ছিল তাই ও মেইন রোডেই ছিল। ক্রিসেন্ট হাসপাতালের রোডে যাওয়ার পরে থেকে মূলত আসল গ্যাঞ্জাম শুরু হয়।

একটানা পুলিশ গুলি শুরু করে থানার সামনে থেকে আর আমরা ইট পাটকেল মারতে থাকি। প্রত্যেকবার আমরা দৌড় দিয়ে যায় থানার দিকে আর ওরা গুলি করে। একেকবারে গুলি করলে ৯-১০ জন আহত হয়। বেশ অনেকের ক্ষত মারাত্মক, বোঝা যায় ভুগতে হবে বেচারাকে ভবিষ্যতে অনেক। এরকম গোলাগুলি চলতে থাকে টানা সন্ধ্যা অবধি। অন্তত ৫০-৬০ জনকে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় রিক্সাতে করে। আমি নিজেও সিরিয়াস ক্ষত হওয়া কয়েকজন ভাইকে ধরে নিয়ে গেছি হাসপাতালে। বেশিরভাগ ছররা গুলি লেগে পুরো পিঠ বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চোখ মুখে ওদের সীমাহীন যন্ত্রণা ছিল। সারাদিনে নিজে চোখে ১০০+ মানুষ আমি আহত হতে দেখছি। এর মধ্যে অনেকেই ছিল মারাত্মক আহত। এক ভাই বলেই ফেললো ব্যান্ডেজ করে আবার আসবো। পুলিশের বাচ্চাকে দেখে নেবো। এরকম চলতে চলতে একসময় দৌড়ে সামনে চলে গেছি আর একটা টিয়ারগ্যাস এসে পড়ছে আমার পায়ের সামনে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছিল শরীরের চামড়া তুলে নিয়ে মরিচ দেয়া হয়েছে। পুরো শরীর পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে যাচ্ছিল। চোখ তো মনে হচ্ছিল আগুন ধরে গেছে। আগুন, পেস্ট কিছুতেই কিছু হয়না। এরকম ৮-৯ মিনিট যন্ত্রণা শেষে কিছুটা স্বস্তি পাই। এরপর থেকে শরীর বেশ দুর্বল লাগা শুরু করে।

রাস্তায় আশেপাশের বাসা বাড়ি, দোকান সবাই মিলে বিস্কুট-কেক-পানি-ঔষধ দিয়ে যাচ্ছিল। কিছুটা লোকলজ্জা বেশি থাকায় প্রচুর ক্ষুধা থাকলেও বিস্কুট নিয়ে খাইনি। যদিও পরে মনে হচ্ছিল কাজটা ঠিক হয়নি কারণ পুরো শরীর বিধ্বস্ত লাগছিল। এরপরে আবার আমরা দৌড়ানি দেই পুলিশকে। দৌড়ানি দিয়ে আমরা পুলিশকে ব্যস্ত রাখি আমাদের দিকে গুলি করতে কিন্তু আমরা গোলির মধ্যে ঢুকে যাই বারবার। এরপরে পুলিশের বেশ অনেকে থানার ছাদে উঠে গুলি করা শুরু করে। তখন আমরা বেশ বিপদে পড়ে যাই কারণ উপর থেকে গুলি করলে নিজেদের প্রটেক্ট করা কঠিন হয়ে পড়ে। স্থানীয় ছাত্রলীগের পোলাপান বিভিন্ন বাসার ছাদে থেকে পুলিশকে ইনফর্ম করছিল কোথায় কেমন লোক। এজন্য অনেকেই ছন্নছাড়া ভাবে বিভিন্ন বিল্ডিঙের দিকে ইট পাটকেল ছুঁড়ে কাচ ভেঙে ফেলে। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি যেন কোনো স্থাপনায় হামলা না হয়। কারণ স্থানীয় মানুষজন যেভাবে হেল্প করছে, রিক্সাআলা মামারা সারাদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে আহত ভাইদের হাসপাতালে নিচ্ছে এসবের পরে স্থাপনায় হামলে করলে তারা আমদের বিপক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বাট দিনশেষে হাজার হাজার মানুষের মিছিলকে কতটুকুই বা কন্ট্রোল করা সম্ভব? এছাড়া এর মধ্যে যখন দেখে থানার সামনে এক ভাইয়ের লাশ পড়ে আছে, ওর মাথা থেঁতলে গেছে তখন কারো সত্যি বলতে হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা। সবাই যেন আমরা নেশার মধ্যে চলে গেছিলাম, যারা এভাবে আমাদের গুলি করে মারতে পারে তাদের সঙ্গে কোনধরনের সমাধানের আলাপ সম্ভব না। একটাই সমাধান, চিরতরে ধ্বংস কামনা।

শেষে সন্ধ্যার দিকে যখন আলো কমে আসে তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে আমরা ৩ জন ফিরে যাবো। কারণ আমাদের হলে ঢুকতে দেবেনা রাত হলে আবার এখান থেকে ভার্সিটি অন্তত ১ ঘণ্টার দূরত্বে। সব মিলে আমরা ৩ জন আমাদের পরিচিত আরো কয়েকজনকে খুঁজে নিয়ে বিধ্বস্ত শরীরে ফিরি সন্ধ্যার পরে। তখনো আমরা জানিনা আসলে সারাদেশে নেট নাই। আমরা ভাবছিলাম শুধু উত্তরাতে নেট অফ ছিল। পরে রুমে ফিরে গোসল করে খাওয়া দাওয়া করে ৫-১০ মিনিট পরে দেখি ব্রডব্যান্ড কাজ করেনা। বুঝলাম মোবাইল নেটওয়ার্কের পরে এবার ব্রডব্যান্ডও অফ করে দিয়েছে।

এই কয়দিন বাসায় প্রত্যেকসময় ফোন করে মিথ্যা বলেছি। দুশ্চিন্তা করবে দেখে কাউকে কিছু জানাইনি। আমি সারাজীবনেও এতো মিথ্যা বলিনি ফ্যামিলির সঙ্গে যত বলেছি লাস্ট এই কয়দিনে। রাতে কাকু ফোন দেয়ায় তাকে আর বাড়িতে ফোন করে সব বললাম এই কয়দিন কি হয়েছে। ওরা বাড়ি ফেরার জন্য জোড় জবরদস্তি শুরু করে। কিন্তু কিছুই কানে না নিয়ে আমি এখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নেই। আজকে যদি আমি কাপুরুষতা করি হয়তো কোনদিন রাতে আর আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারবো না, এই লজ্জা-গ্লানি আমাকে শেষ করে দেবে।

১৯ - ২৩ জুলাই

হলে থেকে গেটের বাইরে যাবার জন্য বলা চলে একরকম নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেয়। বাসায় ফোন করে অনুমতি দিলে গেটের বাইরে যাওয়া যাবে এমন। সব মিলিয়ে একরকম গৃহবন্দি পরিবেশ ছিল। সারাদিন সালেক ভাই, শিপন, এশা, রিয়াদ এদের সঙ্গে ফোন করে খোঁজ খবর নেয়া যে কোথায় কি হচ্ছে। আর টেনশন করা।

কারো কোনো আপডেট সেভাবে পাচ্ছিলাম না, ফোন করে করে খোঁজ খবর নিতে নিতে ফোন বিকাশ দুইটাই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। দুশ্চিন্তায় ঘুম আসেনা, একটা অস্থির ভাব কাজ করে। যেখানেই খোজ নেই শুধু মৃত্যুর খবর আর পুলিশ-র‍্যাবের গুলির খবর। এসব শুনতে শুনতে একটা সময় কেমন যেন অসুস্থ অনুভব করতে শুরু করি। রুমে বসে থেকে কিছু বই আর দুএক্টা ওয়েব সিরিজ এভাবেই কাটতে থাকে সময়।

২৩ তারিখ হল থেকে আল্টিমেটাম মতো দেয় যে বেলা ১২ টার আগে সবাইকে হল ছাড়তে হবে। আগেরদিন থেকেই ইন্টারনেট অফ করে দিয়েছিল যেন সবাই চলে যায়। শেষ অবধি বাধ্য হয়ে চলে যাওয়া লাগে বাসায়।

২৪ জুলাই - ৩২ জুলাই

বাসায় বসে চরম অপরাধবোধে ভুগতেছিলাম। অনবরত গুলি চলছে, গ্রেফতার চলছে অথচ আমি বাসায় বসে আছি এই চিন্তা সারাক্ষণ নিজেকে সবার তুলনায় ছোট প্রমান করছিল। বাসার কয়েকদিন মনে হচ্ছিল আমি জাহান্নামে আছি। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে ঘুম কিছুই ঠিক হচ্ছিলনা শুধু এই চিন্তা থেকে যে আজকে দেশের সব মানুষ যখন বিপদে, আমি সেখানে ঘরে বসে আছি।

৩৩ জুলাই

৩-আগস্ট শহিদ মিনারে জড়ো হবার ঘোষণা আসার পরে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি যদি আর একটাদিনও বাসায় থাকি তবে আমার চেয়ে কাপুরুষ আর কেউ হবেনা। সন্ধ্যার পরে সিদ্ধান্ত নিলাম যা হবার হবে আমি বাসায় থাকবো না। আমি ঢাকায় যাবো। কিন্তু বাসা থেকে তো বের হতে দিবেনা। সুন্দর করে প্ল্যান করে একগাদা মিথ্যা কথা বললাম। বিশ্বাসযোগ্য ভাবে বলার কারণে উপায় না দেখে বাসা থেকে বের হতে দিল। তখনো বাসায় জানেনা আমি ঢাকায় যাবো এন্ড সেটাও আন্দোলনে জয়েন হতে। জুনিয়র ছোট ভাই বিপুল মেসে থাকে মিরপুর ১১ তে, কিন্তু ওও এখন বাসায়। ওর রুমমেট ইউসুফ ভাই ছিলেন। আমি ঢাকায় নেমে ওখানেই ওঠার সিদ্ধান্ত নেই।

৩৪ জুলাই

বের হয়ে পড়েছি একদম সকাল সকাল। বাসে উঠেই চিন্তা শুরু হলো যে ৪ টায় সবাইকে শহিদ মিনারে ডেকেছে, আমি পৌছাতে পারবো তো? যদি ওর্স্ট কেস সিনারিওতেও বাস পৌঁছে যাবে ৩ টায়। কিন্তু ভাগ্যের দোষে, বাস নষ্ট হলো রাস্তায় ৩/৪ বার। এরকম লেট করে যখন বাস থেকে নেমে শহীদ মিনারে পৌঁছাই তখন ৭ টা মতো বাজে। ৮০% মানুষ ফিরে গেছে, শুধু শহীদ মিনারের যে বাউন্ডারি সেটার মধ্যে ৪০০-৫০০ লোক ছিল বলা চলে। এরপরে এই হতাশা নিয়ে ব্যাক করি ৮ টার পরে। আক্ষেপটা থাকবে আজীবন।

১০ টার দিকে মিরপুর-১১ তে বিপুলের মেসে গিয়ে উঠি। ওঠার পরে খেয়াল করি একদম বাসার অপজিটে ছাত্রলীগের অফিস :)

এশা মিরপুরের স্থানীয়, ওর সঙ্গে আলাপ করে ঠিক করা হলো পরেরদিন সবাই মিরপুর-১০ এর গোল চত্বরে আন্দোলনে জয়েন করবো। এশাদের একটা গ্রুপ ছিল আন্দোলনের সময় ফান্ড কালেক্ট সহ অন্যান্য হেল্পের জন্য। গ্রুপ থাকলে যা হয়ে নানাজনের নান মত। এসবে বিরক্ত হয়ে ঠিক করি যার যা করার করুক, আমি আমার মতো যাই। কেউ শেয়ার করে অস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগের সবাই রেডি থাকছে। কেউ শেয়ার করে গাড়ি ভর্তি ছাত্রলীগের পোলাপান হ্যানত্যান। সব মিলিয়ে এইসব গুজব এন্ড মিডল ক্লাস মানুষজনের টিপিক্যাল ফ্যাসিবাদী মনোভাবে বিরক্ত হয়ে ওদের কথা শোনা অফ করে দেই।

৩৫ জুলাই

সকালে নাস্তা করে বের হয়ে দেখি মিরপুর গোল চত্বর অলরেডি স্থানীয় ছাত্রলীগ আর যুবলীগের দখলে। সব হেলমেট, বাঁশ, রড নিয়ে বসে আছে। সামনে আগায়ে গিয়ে পানি ট্যাংকের ঐ রোডে কিছুদূর গিয়ে গার্লস আইডিয়াল কলেজের গোলির মুখে যাই। ওখানে গিয়ে দেখি বেশ অনেক ১০০-২০০ পোলাপান আসছে ওদের সঙ্গে মিছিলে জয়েন করি এন্ড সংঘর্ষ শুরু হয়। যেহেতু লীগ থেকেই খোলাখুলি অর্ডার দিয়ে সারা দেশের ছাত্রলীগের পোলাপানকে বলা হয়েছিল আক্রমণে তাই আগের দিনগুলো থেকে এরা আজকে বেশিই এগ্রেসিভ হয়ে ওঠে। সবার হাতে পিস্তল, বাঁশ, হকিস্টিক আর মাথায় হেলমেট। এসব নিয়ে ওরা আক্রমণ করছে আর আমরা প্রতিরোধ করছি। আমাদের টার্গেট ছিল গোল চত্বর দখলে নেয়া এবং লীগকে রাস্তা থেকে সরানো।

আগে যে ২/১ দিন আন্দোলনে গেছি কখনোই সরাসরি পুলিশ বা ছাত্রলীগের গুলির সামনে দাড়াইনি বলতে গেল। উত্তরাতে থাকার দিন একটা ৯০ ডিগ্রি রাস্তার মোড়ে এক পাশে আমরা আর অন্য পাশে পুলিশ ছিল। এরপরেও গুলি লাগার সম্ভাবনা ছিল বেশ কয়েকবার, টিয়ারশ্যেলও খাইছি বেশ। কিন্তু সরাসরি লাইভ ব্যুলেটের সামনে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা এই মিরপুরেই আজ প্রথম।

সকাল থেকে বিকেল অবধি কতবার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে সে খেয়াল নাই। টিয়ারশ্যেল, রাবার বুলেট, ছররা ব্যুলেট এসে লেগেছে বেশ কয়েকটা। কোনটাতেই খুব বেশি আঘাত লাগেনি। শুধু ২ টা বড় ইট এসে লাগছিল পায়ে আর মাথায়। এরপর থেকে বেশ মাথাব্যাথা আর হাঁটতে সমস্যা হচ্ছিল।

পুলিশের ভেস্ট, গাড়ি ইভেন অস্ত্রও ছিল লীগের পোলাপানের কাছে। সেসব দিয়ে গুলি করে বেশ কয়েকজনকে আহত করে। বারবার ধাওয়া পাল্টা ধাওয়াতে একসময় অনেক মানুষ হয়। অন্তত আমাদের এই গলিতেই হাজারের বেশি মানুষ। আশেপাশের গলি গুলোতেও হাজার হাজার মানুষ ছিল। সবাই মিলে ধাওয়া দিয়ে একসময় গোল চত্বরে দাঁড়াতে পারি। ৪/৫ মিনিট পরেই আবার গোলাগুলি করে ওরা আমাদের ধাওয়া দিয়ে গোল চত্বর দখল করে। এরকম দখল বেদেখল বেশ কয়েকবার হওয়ার পরে যখন আমরা ওদের উল্টো রাস্তায় আটকে ফেলার মতো অবস্থায় তখন হুট করে র‍্যাবের অনেকগুলো গাড়ি আসে। এসে ফাঁকা ফায়ার করে সবাইকে শান্ত করে এন্ড ছাত্রলীগ X বেশ কিছু পুলিশকে সেফ এক্সিট দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পরে গোলচত্বর ছেড়ে র‍্যাব চলে যায়।

আশেপাশের সবাই এসে স্লোগান দিয়ে সেলিব্রেট শুরু করে। মূলত আর্মী এসেছিল সন্ধ্যা থেকে যে কারফিউ সেটা বাস্তবায়নের জন্য আর লীগ-পুলিশকে সেফ এক্সিট দিতে। তা নাহলে ঐদিন খুব বাজে একটা পরিস্থিতি হয়ে যেত। মিছিল শেষে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিল দেখে মেসের দিকে যেতে থাকি।

রুমে ফিরে গোসল গোসল শেষে খাওয়া দাওয়া করে ঘুম দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু একদিকে মাথা ব্যাথা বাড়ছিল আর মেসেঞ্জারে একটা গ্রুপে এড ছিলাম ওখানে একেকজনের উল্টাপাল্টা স্টুপিড মার্কা কথাবার্তা আর গুজব ছড়ানো দেখে কয়েকটা হার্শ কথা বলছিলাম। এইটা নিয়ে আরেকজনের সঙ্গে আবার একটু রাগারাগি। এসব করে যখন বিরক্ত তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। শুনলাম মিছিল শেষে যখন মানুষ কমে যায় তখন নাকি লীগের পোলাপান আক্রমন করছিল সুযোগ নিয়ে। কিন্তু ভেরিফাই করতে না পারায় আর মাথা না ঘামিয়ে ঘুমানোর প্রিপারেশন নিতে থাকি।

মিরপুরের এক অপরিচিত স্থানে-অপিরিচত বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি এই সময় চিন্তা করছিলাম সকালে ঠিক কী কী খারাপ হতে পারে। মোবাইলে ৪/৫ টা নতুন দোয়া শিখছি। :3 একটু আগে আম্মুকে ফোনে রাগারাগি করেছি। এক পর্যায়ে বলে ফেলেছি তোমরা সবাই স্বার্থপর, শুধু নিজের ছেলের কী হলো সেটা নিয়েই চিন্তিত। এরকম বাসায় আমি আর যাবো না। ( পিওর ইমোশনাল স্টাফ, বাট ইউ নো… )

রুমের পাশের এক ছেলে এসে বলে গেল তার নাকি এক ক্লোজ বড় ভাই আর্মিতে আছে তাদের নাকি অর্ডার দেয়া হইছে কালকে রাস্তায় যারে পাবে তারে গুলি করবে। এসব খুব কমন হয়ে গেছে, যে যা পারে বলে ফেলছে। ইন্টারনেটে যেতে ইচ্ছা করেনা গুজব দেখে। মানুষ ভয় দেখায়ে কি অর্জন করবে জানিনা। ব্রেইন খাটাতে ইচ্ছা করছিলনা দেখে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। তখন বোধহয় রাত ২ টা বাজে।

সোশ্যাল মিডিয়া খুলে দেখি বিকেলের দিকে আসিফ মাহমুদ পোস্ট দিয়েছেন যে পুর্ব নির্ধারিত ৬ আগস্ট না, লং মার্চ টু ঢাকা হবে ৫ আগস্ট। ক্লান্তি তখনই থেমে গেছে, কিছুক্ষণ সোশ্যাল মিডিয়ায় আপডেট নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঘুম হচ্ছিল না দেখে কিছু দোয়া মুখস্ত করলাম কালকে বিপদে কাজে লাগবে ভেবে। একচুয়ালি টেনশনে ছিলাম প্রচুর কারণ আশেপাশে প্রচুর গুজব ছড়াচ্ছিল। একবার ভাবলাম আমার হাতে অপশন আছে নাকি আর। দেখি অপশন বলে কিছু নাই। কালকে গুলি চললেও যাবো, কালকে সেনাবাহিনী গুলি করলেও যাবো, কালকে ঝড় তুফান আসলেও যাবো, কাল যদি কেয়ামত শুরু হয় তাও যাবো কারণ কেয়ামতের সময় হাতে গাছ থাকলে লাগানোর নির্দেশ আসছে আর এতো ফেরাউন সরানো প্রকল্প। আর যদি এমন হয় আমার মৃত্যু ১০ দিন পরে তাহলে পুলিশ ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি করলেও মরব না। মৃত্যু যদি আজকে রাতে থাকে তাহলে আন্দোলনে যাওয়াও লাগবেনা এমনিতেই মরে যাবো। যা হবার হবে ভেবে লাভ নাই। আর তাছাড়া যদি মারা যাই তাহলে শহীদ হতে পারবো। আল্লাহর রহমতে শহীদ হতে পারলে এর চেয়ে ভালো কিছু হবেনা। আর বেঁচে থাকলে তো হলোই। ঘুম আসছিল না টেনশনে, নিজেকে বোঝাচ্ছিলাম আমাদের আর উপায় ছিলনা। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সামনে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকেনা।

৩৬ জুলাই

ফজরের আজানে উঠে দেখি ঘন্টাখানেক আগেই মাত্র ঘুমাইছি। লাস্ট কোন নামাজে কবে আমি এতো মনোযোগ দিয়েছি বলতে পারবো না। বিপদে শুধু নাস্তিকরাই আল্লাহর নাম নেয়না, মুসলমানরাও নামাজে মনোযোগ পায় :3

সকালে উঠে দেখি বাসা থেকে ফোন দিল, দিয়ে বললো যেন সাবধানে থাকি। চিন্তা করতে নিষেধ করলো, যা হবার হবে। আম্মুর কথা শুনছি তখন আমি দাঁড়ায়ে রাস্তায়, সামনে আর্মির টহল চলছে সারা রাস্তা ফাঁকা। রাস্তা ফাঁকা দেখে কয়েকজনের থেকে খোঁজ নিয়ে শুনলাম কেউ নাকি বের হয়নি রাস্তায়। তখন রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে চিন্তা করছি কি করবো। আশেপাশে পরিচিত কেউ নাই। শেষ অবধি ডিসিশন নিয়েছি দরকার হইলে একাই যাবো কাউকে লাগবেনা। এগেইন পিওর ইমোশন ড্রিভেন ডিসিশন।

রাস্তা দিয়ে চক্কর দিয়ে আসলাম, রাস্তাঘাটে মানুষ নাই সেরকম। মন খারাপ হয়ে গেল, মনে হলো মানুষজন ভয় পেয়ে নামেনাই।

একটা হোটেল থেকে নাস্তা করে একটা সফট ড্রিংক্স নিয়ে 4 নাম্বার রোডের রাস্তা-গোলি এরকম ঘুরঘুর করছি। কিছুক্ষণ পরে হুট করে দেখিযেন কয়েক হাজার মানুষ অপজিট রোড অর্থাৎ পপুলার মসজিদ এর ঐ পাশের রোড দিয়ে আসছে। মিছিলের সাইজ বাড়তেছেই। এইটা দেখে আমি যেখানে দাঁড়াইয়ে আছি সেখানেও ২০০-৩০০ লোক জড় হয়ে গেল। সেনাবাহিনীর কয়েকজন কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু কেউ শুনছেনা। তারকাটা দিয়ে আমাদের ব্লক করে রাখছে।

ফোনে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো জানাল সেনাপ্রধান নাকি টিভিতে বক্তব্য রাখবে। খুব ইন্টারেস্টিং লাগলো। মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হলো। আবার আশংকা ছিল যদি আজকে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেয় তাহলে? তাহলে এত মানুষের জীবন কি বৃথা যাবে? এসব ভাবতে ভাবতেই দুইটা ছেলে কোথা থেকে লাফ দিয়ে তারকাটা পার হয়ে রাস্তার মাঝে চলে গেছে। আর্মি ওদের দুইজনকে আটকাতে আটকাতে দুই পাশ থেকে হাজার হাজার মানুষ তারকাটা ফেলে দিয়ে রাস্তায় চলে এসেছে। শুরু হয়ে গেল আকাশ চৌচির করে দেয়া স্লোগান। মাথায় টূপি, কপালে সিঁদুর, পাঞ্জাবি, শার্ট-প্যান্ট, সালোয়ার কামিজ সবাই যেন এক হয়ে গেছে। যখন মেট্রোর একেকটা স্টেশনের নিচে মিছিল যাচ্ছিল তখন যে অসাধারণ ইকো হচ্ছিল গায়ে কাটা দিচ্ছিল।

আমি জীবনে একসঙ্গে এত মানুষ কোনদিন দেখিনাই। মনে হচ্ছিল সারাদেশের সব মানুষ আজকে রাস্তায়। এবং মজার জিনিস হচ্ছে সবার মধ্যে এই কনফিডেন্স চলে আসছে আজকেই আমাদের শেষ আন্দোলন। আর আগামীকাল আমাদের আসা লাগবেনা। কারণ খবর পেলাম উত্তরা, সাভারের দিকে এর চেয়েও কয়েকগুণ মানুষ। ইভেন সারাদেশের মানুষ হাজারে হাজারে করে মিছিল নিয়ে ঢাকায় ঢুকছে। ঐ সময় আমি ধরেই নিয়েছি শেখ হাসিনা ডান। তখন ১ টা মতো বাজে।

তখন মিছিল আগারগাও, খবর পেলাম শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে পালাইছে। তবে তাতে কিছু যায় আসেনা। গণভবনের সামনে দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন অনেকে দেখি দৌড়ে গণভবনে ঢোকার চেষ্টা করছে। ভয় হলো কয়েকজনের হঠকারিতায় পুরো আজকের কার্যক্রম ভেস্তে যেতে পারে। সিকিউরিটি কন্সার্ন দেখলে আর্মি সুযোগ পাবে একশনে যাওয়ার। আমরা কয়েকজন মিলে আর্মির সামনে গিয়ে এদের আটকে দিয়ে শাহবাগে যাওয়ার জন্য বলতেছিলাম। চেহারার মধ্যে একটা বড় মানুষের ভাব আছে + ভয়েসের ভলিউম যথেষ্ট ভাল দেখে মনে হলো কনভিন্স করতে পারছিলাম। এরমধ্যে একজন এসে বলে সে নাকি সমন্বয়ক তাকে নাকি কেন্দ্রীয় সমন্বয়করা বলেছে এখন গণভবনে ঢুকতে। :3 তখনো ইন্টারনেট নাই, বললাম কিভাবে বললো আপনাকে। বলে মেসেজে, দেখতে চাইছি মেসেজ। বান্দা গায়েব। এরকম বেশ কিছু “সমন্বয়ক” দেখছি ঐ কয়দিনে।

পরে গুটি কয়েকজন ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলো বাকি সবাই মুভ করছে শাহবাগের উদ্দেশ্যে। বাট আমাদের সামনে তো হাজার হাজার মানুষ। আবার এইসব ঘটনায় হয়ে গেছি লেট।

এভাবে গিয়ে যখন আমরা শাহবাগে পৌঁছেছি মাত্র তখন শুনি Hasina made us fly :3 সবাই অপজিট দিকে গণভবনে ছুটছিল। আমি সবার আগে আম্মুকে ফোন দিলাম। দিয়ে বলেছি, “আম্মু, বাংলাদেশ স্বাধীন। হাসিনা নাই।”

কিছুক্ষণ পরে দেখি পা বেশ ফুলে গেছে। গতকাল লাগছিল পায়ে আবার আজকে এতক্ষণ হাঁটছি। এর মধ্যে জুতায় ঘসা লেগে পায়ের চামড়া উঠে জ্বলছে অনবরত। প্যান্টের মধ্যে র‍্যাশ হয়ে গেছে বুঝতেছি হাঁটার অবস্থা নাই। কিন্তু আশেপাশে যখন দেখি সবাই এতো আনন্দে তখন আর কিছু মনে হয়নি।

অনেকেই অনেকভাবে ফিলিংটা বোঝানোর চেষ্টা করছিল। আমার কাছে খুব সাধারণ একটা ফিলিং। শুধু মনে হচ্ছিল বুকের উপর থেকে বিশাল একটা পাহাড় নেমে গেছে। কেন জানিনা আনন্দ ফিল করিনি, খুব উচ্ছ্বসিতও লাগেনি। স্বাধীনতা তো আমাদের অধিকার, উপহার না। অধিকার ফিরে পেলে কেন আনন্দ হবে? হয়তো স্বস্তি হওয়ার কথা। আমার স্বস্তি হয়েছে। আমার মনে হয়েছে এই মুহূর্তে যদি সম্ভব হতো আমি হাসিনার পুরো রেজিমের টাইমলাইনে যারা খুন হয়েছে গুম হয়েছে সবাইকে সুবিচার দিতাম। আমি যে আজ দেড় বছর ঢাকায় এসেও সাহস করে সন্ধ্যার পরে ঢাবিতে থাকিনাই এই ভয়ের সংস্কৃতির বিচার করতাম।

এরপরের ঘটনা সবাই ইন্টারনেটে দেখেছে, ছবি দেখেছে। কেউ নাক শিটকিয়েছে, কেউ খুশি হয়েছে, তর্ক হয়েছে। তাই আর কিছু লিখব না। যা হচ্ছে হোক হোক। সবকিছু চলুক, মানুষ বুকভরে শ্বাস নিচ্ছে। নিক।

পুরো আন্দোলনে আমার উল্লেখযোগ্য কোন অবদান নাই, আমি এজন্য হীনমন্যতায় ভুগি। তবে আবু সাঈদের মায়ের মনে আজকের দিনে একটা মুহূর্তের জন্যও যদি আনন্দ জাগে, যদি এক্টাবারের জন্য মনে হয় তার ছেলে একা না। তবে আমার জীবন স্বার্থক। একজন ছেলে হারানো মায়ের মনে আনন্দ ফোটানোর পেছনে একটা কারণের অংশ যদি আমি কোনভাবে হতে পারি আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবো।

ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে তুলে এনে ঈষৎ পরিমার্জন করা।