বুক রিভিউঃ এটাই সায়েন্স
December 22, 2024 by Shahriar Ahmed Shovon
বিজ্ঞান রিলেটেড বই কিন্তু একাডেমিক ধাঁচের না, এরকম কিছু শুনলেই আমাদের মাথাতে যেসব কনসেপ্ট আসে সেগুলো মোটাদাগে অনেকটা মহাকাশবিজ্ঞান, গণিত বা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী এই কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। এর বাইরে খুব বেশি কিছু মাথায় আসেনা। বিশেষ করে বাংলা ভাষায় বহুকাল ধরে বিজ্ঞান লেখা গুলো কিছু স্টেরোটাইপে বন্দি হয়ে আছে বলা যায়। আর সেই বন্দিদশা থেকে মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ বলবো এটাই সায়েন্সকে। লেখক হাসান উজ-জামান-শ্যামল লেখাপড়া শেষ করে ২ বছর কাজ করেছেন আইসিডিডিআর, বি বা কলেরা হাসপাতালে। এরপরে পারি জমিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে পিএইচডি সম্পন্ন করতে। যে ২ বছর কলেরা হাসপাতালে কাজ করেছেন সেই ২ বছরে উনি যেসব গবেষণার সঙ্গে ছিলেন বা সহকর্মীরা যেসব গবেষণা করেছেন সেগুলোর গল্প এই বইতে আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন।
শুনতে বেশ বোরিং লাগছে, তাইনা? স্পেশালি কলেরা হাসপাতাল বা জনস্বাস্থ্য রিলেটেড কি এমন গল্পই বা আছে যেটা ইন্টারেস্টিং? ওয়েল, আপনাকে হতাশ করে বলতে হচ্ছে এখানে যে গল্পগুলো উনি তুলে ধরেছেন প্রত্যেক্টাকে কোনো কল্পনাপ্রসূত থ্রিলার গল্পের চেয়ে কম বলতে পারবেন না।
এই যেমন ধরুন আর্সেনিকের কথা। আর্সেনিক আসলেই আপনার মনে হবে হাতে পায়ে ফোটা ফোটা দাগ, স্লো পয়েজন, পানিবাহিত রোগ, টিউবয়েলের গায়ে লাল-সবুজ রং করে চিহ্নিত করা। এর বাইরে হয়তো আপনি কিছুই জানেন না। কিন্তু আমি যদি বলি আর্সেনিক আমরা নিজে হাতে নিজেদের মধ্যে হাজির করেছি, বিশ্বাস হবে? এবং সেটাও আবার একটা এক্সিডেন্টালি অর্থাৎ একটা সমস্যা সল্ভ করতে গিয়ে আমরা আর্সেনিক হাজির করেছি। ইন্টারেস্টিং লাগছেনা?
এখনো আর্সেনিক নিয়ে আসল ঘটনা কিন্তু আমি বলিনি। আচ্ছা রাশিয়ার চেরনোবিলের ঘটনা জানেন তো, তাইনা? নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট ডিজাস্টারের ঐ ঘটনায় তেজস্ক্রিয়তায় ক্যান্সারে মৃত্যুর সম্ভাবনা সাড়ে ৪ হাজার মানুষের। অনেক, তাইনা? ইতিহাসের অনেক বড় একটা ঘটনা। কিন্তু আপনি কি জানেন এর থেকে বড়, ওয়েল কয়েক গুণ বিশাল একটা ডিজাস্টার এক সময় এই বাংলাদেশে হয়েছে, তাও আর্সেনিকের কারণে? হ্যাঁ, একটা সময় প্রতি বছর বাংলাদেশের ৪৩,০০০ এর বেশি মানুষ মারা গেছে এই আর্সেনিকের কারণে। এবং সেটার পরিমাণ তুলনামূলক কম হলেও এখনো চলমান। বুঝতেছেন কত বিশাল? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক রিপোর্টার এ ব্যাপারে লিখেছেন, “The largest mass poisoning of a population in history”. নিশ্চয় বুঝতেছেন কত ভয়ংকর একটা বিষয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ভয়ংকর বিষয়টাকে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা তাদের অসাধারণ দক্ষতা আর বুদ্ধি দিয়ে অনেকটা সল্ভ করে ফেলেছেন। এন্ড এই সমাধানের গল্পটা এতো রোমাঞ্চকর আপনি ধারণাও করতে পারবেন না। চেরনোবিলের তুলনায় ১০ গুণ বড় একটা ডিজাস্টার নিয়ে কত ইন্টারেস্টিং গবেষণা আর প্রব্লেম সল্ভ হয়েছে একবার ভাবুন। চলুন আরেক্টা গল্প শোনায়।
ভারতকে নিয়ে পুরো বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ট্রল করা হয় যে টপিকে সেটা হচ্ছে স্যানিটেশন। ২০১৯ এর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের প্রায় ৬০% এর বেশি জনগোষ্ঠী খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগ করে। এই পরিমাণ নেপাল আর পাকিস্তানেও কম না। এখন প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদের এখানে কত বলে মনে হয়? ১০? ১৫? ওয়েল, দ্যাটস জিরো। অবাক করার মতো বিষয় না? এই মজার বিষয়টা কিভাবে হয়েছে বলে মনে হয়? একটা হিন্ট দেই, এই পুরো বিষয়টা সল্ভ করেছেন ডক্টর কমল কর এবং একটা পয়সাও বিনিয়োগ না করে, কোনো ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার না করে। কি মনে হচ্ছে মিনা কার্টুনের “স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা লাগবো…” টাইপ কোনো এক্টিভিজম দিয়ে? না, হয়নি। পুরো সমাধানটা উনি সম্ভব করেছেন স্রেফ সাইকোলজি আর হিউম্যান বিহেবিওর দিয়ে। শুনতে ম্যাজিক মনে হলেও ঘটনাটা খুব উইয়ার্ড আর মজার। পুরো প্রক্রিয়া যে দুই পেজে আলোচনা করা হয়েছে ঐ দুই পেজ পড়ে আমি লিটারেলি ৫ মিনিট যাস্ট হাসছি। একটা এতবড় সমস্যার সমাধান কি এমন হতে পারে যেটা পড়ে আপনি হাসবেন? কি? রহস্যজনক না?
এতো গেলো মাত্র দুইটা সমস্যার সমাধান আর তার পেছনের গল্প। এরকম ৮ টি গল্প নিয়ে পুরো বইটি সাজানো। এছাড়া ভূমিকা থেকে শুরু করে অন্যান্য যে অংশ আছে সেখানেও অনেক অসাধারণ বিষয়ের কথা আছে। এই যেমন সায়েন্টিফিক রিসার্চ পেপার কেন এখন অবধি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সোর্স বা রিসার্চের ইন্টার্নাল অনেক ব্যাপার কিভাবে কাজ করে।
এই বইয়ের যে শুধু বিষয়বস্তু অনেক ভালো তাই না, লেখকের লেখার স্টাইল নিয়ে যদি না বলি রীতিমত অপমান হবে। পুরো বইয়ে খুব মার্জিত আর সুন্দর রম্যের ব্যবহার আছে। পড়তে গেলে আপনার মুখে একটা হাঁসি ফুটে থাকবে। এতো প্রাঞ্জল ভাষায় বিজ্ঞানের বই লেখা সম্ভব সেটা আপনি এই বই না পড়লে বুঝতে পারবেন না। গল্প বলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট যেটা আমি মনে করি সেটা হচ্ছে গল্প বলার ফ্লো বা ধারবাহিকতা। এই পুরো বইতে একটা সিঙ্গেল লাইনেও সেই ফ্লো ব্রেক করেনি। লেখকের সঙ্গে স্মুথ একটা জার্নি ছিল পুরো বইটা সেটা বলতে আপনি বাধ্য হবেন। আমি এক বসাতে পুরো বই শেষ করেছি, প্রয়োজনীয় জায়গায় রিমার্ক করেছি। ২০২১ সালে প্রথম প্রকাশ হলেও আমি কেন এতদিন পরে বইটা পড়লাম সেটা নিয়ে একটা আক্ষেপ কাজ করছে মনের মধ্যে। আশা করি আপনি আর সেই আক্ষেপ না বাড়িয়ে দ্রুত পড়ে ফেলবেন।
এই বইমেলাতে এখন অবধি যে বইগুলো পড়েছি তার মধ্যে সেরা বই এটাই সায়েন্স।
বইয়ের নামঃ এটাই সায়েন্স
লেখকঃ হাসান উজ-জামান শ্যামল
প্রকাশনীঃ অধ্যয়ন প্রকাশন
Categories
Recent Posts
About
This is my personal blog, where I write about various topics related to software development, technology, and my own experiences. I enjoy exploring new technologies, frameworks, and programming languages, and sharing what I learn with others.