Blog

Post Thumbnail

বুক রিভিউঃ বাঙালি মুসলমান প্রশ্ন

December 27, 2024 by Shahriar Ahmed Shovon

ব্যক্তি তার পুর্বপুরুষদের সাথে একাত্ম হতে চায়, তাদের সংগ্রামকে এম্ব্রেস করতে চায়। তাদের জাতিগত শৈশব, শিশুকালের স্মৃতিকে ধারণ করতে চায়। আর এই ধারণ করতে চাওয়া থেকেই আসে পরিচয় খোঁজার কার্যক্রম। পরিচয় খোঁজা এবং এরপরে খুঁজে পাওয়া পরিচয়ের ভিত্তিতে যে কমিউনিটি পাওয়া যায় সেখানে নিজেকে সংযুক্ত করার মাধ্যমেই আত্মপরিচয়ের সংকট কাটে।

বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের সেই আত্মপরিয়চের সংকট বহুদিনের। বঙ্কিমচন্দ্র প্রবন্ধ লিখে এই সংকট নিরসনের চেষ্টা শুরু করেছিলেন, বলা বাহুল্য তা ছিল চরম সাম্প্রদায়িক এবং ঘৃণ্য রাজনৈতিক চিন্তাসম্পন্ন। এরপরে বহুকালে বহুজন লিখেছেন, আহমদ ছফার বাঙালি মুসলমান মন কিংবা গোলাম মুরশিদের হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি সব একই ধারার লেখা। অর্থাৎ রেটোরিক ভিন্ন ভিন্ন হলেও প্রায়ই উপসংহার এসে একই সরলরেখায় মিশে যায়। বাঙালি মুসলমান সমাজ নিম্ন বর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত তত্ব, বহিরাগত মুসলমান তত্ব এ যেন সব লেখার একই পরিণতি।

বাঙালি মুসলমান প্রশ্নে লেখক হাসান মাহমুদ অন্যদের মতো প্রথমেই পরিচয়ের সংকট নিরসনে উদ্যোগী হননি। হয়তো সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু মাহমুদ মনে করেছেন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে অন্যরা যেসব উত্তর দিয়েছেন সেখানে কী কী সমস্যা আছে সেটা দেখানো জরুরি। অর্থাৎ নতুন করে প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আগের উত্তরের সঙ্গে যদি কলিশন করে অবশ্যই আগের উত্তরের কী কী দোষে নতুন উত্তরের প্রয়োজন হলো সেটা প্রথমেই বলে নেয়া বাঞ্ছনীয়। লেখক তাই করেছেন। ওরিয়েন্টালিস্ট নজরে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কেন সব লেখার উপসংহার একই পথের পথিক হয়।

পুর্বের লেখার সমস্যা, এবং সেই সমস্যার কারণ উদ্ঘাটনের পরে হাসান মাহমুদ শুরু করেছেন মূল আলাপ। অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানের উৎপত্তি, তার জন্মের ইতিহাস-রাজনীতি। প্রথমে মনে হয়েছিল লেখক বোধহয় তার নিজের কোন গবেষণা তুলে ধরবেন। তবে আশার কথা তার প্রয়োজন হয়নি। বরং বাঙালি মুসলমানের জন্ম-ইতিহাস নিয়ে খুব প্রসিদ্ধ দুইটি গবেষণা সেই ‘৮৩ এবং ‘৯৩-থেকেই জনপরিসরে উপস্থিত। যদি প্রসিদ্ধই হবে তবে আর এই বই লেখার প্রয়োজন হলো কেন? ওয়েল, লেখক দাবি করেছেন উপরোক্ত দুই গবেষণাই প্রচলিত ধারায় পড়া হয়েছে আংশিক এবং ভুলভাবে। খুব বড় ধরনের আপত্তি, কারণ জনপ্রিয় বিভিন্ন এক্টিভিস্ট-লেখক যেমন সলিমুল্লাহ খান এই গবেষণা নিয়ে কথা বলেছেন আপত্তি তুলেছেন। তবে লেখক সঠিকভাবে পড়া এবং সম্পূর্ণ পড়া বলতে কী বলতে চাইছেন?

অধ্যায় নম্বর ৩ এবং ৪-এ যথাক্রমে অসীম রায় এবং রিচার্ড ইটনের গবেষণাকে হাসান মাহমুদ পড়ছেন প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার নিমিত্তে এবং একই সাথে প্রচলিত ধারায় যে সমালোচনার উপস্থিতি তা কেন ভুল উপস্থাপন, তা ব্যাখ্যা করে।

অসীম রায়ের‍ সমন্বয়ী ইসলামের ধারণাকে আংশিক ধারণ করে বলা হয় বাংলায় ইসলাম প্রচার হয়েছে পীর-দরবেশদের মাধ্যমে এবং তাই বাংলার ইসলাম সূফী-ইসলাম। এই কথার প্রথম আলোচনা অসীম রায় করলেও মোটেও এভাবে করেননি। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব না হয়েও পীরিফিকেশন হয়েছে এবং সামাজিকভাবেই ইসলামের প্রচার হয়েছে। তার গবেষণাকে আংশিকভাবে গ্রহণ করার সমালোচনা করেছেন হাসান মাহমুদ।

রিচার্ড ইটনের সাড়া জাগানো The rise of Islam and the Bengal Frontier গবেষণাগ্রন্থকে নির্ভর করে গড়ে উঠেছে চতুর্থ অধ্যায়। রিচার্ড ইটনের দাবি, বাংলায় মুসলমান সমাজের আবির্ভাব মুঘল আমলের একদম গোড়াপত্তনের সময়ে এবং কৃষি-সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ায়। একইসাথে রিচার্ড ইটন প্রচলিত নিম্ন বর্ণের হিন্দু থেকে ধর্ম পরিবর্তন করে ইসলামে আসা কিংবা বহিরাগত মানুষের মাধ্যমে ইসলামের আবির্ভাব তত্বের ইতি টেনেছেন।

সর্বশেষ অধ্যায়ে মাহমুদ সামগ্রিকভাবে পুরো আলোচনার ইতি টেনেছেন জাতি-জাতিরাষ্ট্রের অল্প আলাপ, পরিচয়ের রাজনীতির আলোচনা এবং উপরোক্ত গবেষণাদ্বয়ের ব্যাপারে সমালোচকদের আপত্তির জবাব দিয়ে।

সামগ্রিকভাবে যদি এক বাক্যে বইয়ের পরিচয় দিতে চাই তবে, “বাঙালি মুসলমানের পরিচয়মূলক আলাপে বিরাজমান চিন্তার ভ্রান্তি, রায়-ইটনের গবেষণার সারমর্ম, সমালোচনার জবাব এবং উক্ত বিষয়গুলোর সমন্বয়ে বাঙালি মুসলমান প্রশ্নের উত্তর।”

ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে পড়ে বেশ চিন্তার খোরাক যোগায় এমন লেখা মনে হয়েছে। আহমদ ছফার বাঙালি মুসলমান মন এবং বঙ্কিমের আলোচিত দুই প্রবন্ধ আগে পড়া থাকায় আলোচনা ধরতে সুবিধা হয়েছে মনে হলো। তবে অসীম রায় আর রিচার্ড ইটনের গবেষণা দুটো আমার সামগ্রিকভাবে পড়া হয়নি। অর্ডার করেছি, আজকে হাতে পাবার কথা। গবেষণাদুটো পড়া হলে বোধহয় আরো ভালো করে আমি বুঝতে পারবো।

রকমারি, গুডরিডস সহ বিভিন্ন জায়গায় বইয়ের সমালোচনাগুলো পড়ে মনে হলো বেশিরভাগ পাঠক সামহাও নতুন তত্ত্ব নিতে খুব অস্বস্তিতে আছেন এবং ভুল পাঠ করেছেন। হ্যাঁ, হাসান মাহমুদের গদ্য লেখার দক্ষতার প্রশংসা করাটা কঠিন। আলোচনার মোড় বিভিন্ন জায়গায় অযাচিত ভাবে ঘুরে গেছে। আশা করছি গদ্যে তিনি ধীরে ধীরে দক্ষ হয়ে উঠবেন। তবে মূল আলাপ হাজিরের ধরনে তিনি প্রশংসার দাবিদার।