Blog

Post Thumbnail

'২৪ এর আন্দোলন এবং মধ্যবিত্তকে সম্পৃক্ত করাঃ

October 18, 2024 by Shahriar Ahmed Shovon

সব সমাজে কিছু কাল্ট থাকে, সেই কাল্ট বিরুদ্ধ কোনো কাজ সমাজের মানুষ ভালো চোখে দেখেনা। বিরুদ্ধে যে যায় সে বারবার অজুহাত দিতে থাকে, সাফাই গায় তার অপারগতার পক্ষে।

গত ৫০ বছরে আওয়ামীলীগ এরকম কাল্ট তৈরি করেছে শেখ মুজিবকে নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। আপনি শেখ মুজিবের বিরোধিতা করলে আপনাকে বারবার ডিস্কেলেইমার দেয়া লাগে যে আপনি তার ভালো কাজের প্রশংসা করেন। জিয়াউর রহমান বা অন্য কারো বিরোধিতা করতে কিন্তু এমন ছাফাই লাগেনা। অথবা মুক্তিযুদ্ধ, বারবার আপনাকে স্বীকার করতে হয়। জামায়াতকে “মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্ন” ডিল করে আসতে বলা হয়। আওয়ামীলীগ X রক্ষী বাহিনীকে কিন্তু বিহারী গণহত্যা প্রশ্ন ডিল করে আসতে বলা হয়না।

কাল্ট তৈরি হলে আপনাকে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবেনা। বরং সমাজের মানুষই কাল্ট জারি রাখবে। “তুমি শেখ মুজিবকে জাতির পিতা ভাবো না?” টাইপের তীর্যক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। আপনি পাল্টা প্রশ্ন কিংবা পাবলিক স্পেসে খোলাখুলি আলোচনা করারও স্থান পাবেন না।

‘২৪ এর আন্দোলনকে সফলভাবে সেই কাল্ট হিসেবে তৈরি করা গেছে। ছাত্রলীগের বহু কর্মীকে বারবার ছাফাই গাইতে হয়েছে যে সে হত্যা সমর্থন করেনা কিন্তু সরকার পতন চাওয়া বিএনপি জামায়াতের আতাত ব্ল্যাহ ব্ল্যাহ। চিহ্নিত আওয়ামী ছেলেটাও ক্লাসে সবার কাছে অচ্ছুৎ হবার ভয়ে প্রোফাইল লাল করেছে। ইভেন এখনো কেউ এই সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে আগে বলে নিচ্ছে, “আমি আন্দোলনে ছিলাম।” অর্থাৎ সরাসরি আন্দোলনের বিপক্ষে গেলে কাল্ট তাকে বাঁধা দিচ্ছে। আমার ব্যক্তিগত মতামত কাল্ট হিসেবে আন্দোলনকে উপস্থান করাটাই ‘২৪ এর আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সফলতা।

কেন এই কথা বলছি?

আন্দোলন যতই যৌক্তিক হোক কিংবা আদর্শিক কিংবা ন্যায্য সেটার পক্ষে আপনি মধ্যবিত্তের জনসমর্থন আনতে পারবেন না। ঠিক এই কারণে বিএনপি-জামায়াত এতো নির্যাতিত হয়ে, ‘১৩ তে হেফাজত গণহত্যার শিকার হয়েও মধ্যবিত্তকে টানতে পারেনাই। উল্টো মধ্যবিত্তের প্রোপাগান্ডা আর মকের শিকার হয়েছে। কাল্ট তৈরি না হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল আন্দোলনরত ব্যক্তিদের সঙ্গে মধ্যবিত্তের কোনো সোশ্যাল কন্টাক্ট না থাক। এবং খেয়াল করেছেন কাল্ট তৈরি হতে দেবে না বলেই আওয়ামী সরকার এই আন্দোলনকে বিএনপি-জামায়াতের নিজস্ব আন্দোলন বলে চালাতে চেয়েছে। আদারিং করতে চেয়েছে যেন কাল্ট তৈরি না হয়।

এই আন্দোলন কাল্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার প্রমাণ কী?

খেয়াল করবেন দেশের বিশাল একটা মধ্যবিত্ত সমাজ আওয়ামীলীগকে সমর্থন দেয়। সরাসরি মাঠে থেকে না, বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধচারণ করে, তাদের নির্যাতনে চুপ থেকে এবং “বিকল্প কে?” প্রশ্ন উত্থাপন করে। এই আন্দোলনে ঐ বিশাল জনগোষ্ঠীও বাধ্য হয়েছে সমর্থন দিতে। হ্যাঁ সমর্থনের ধরণ আলাদা ছিল। তারা আন্দোলনে “আর রক্তপাত চাইনা, বন্ধ হোক এসব। প্রাণের ক্যাম্পাস শান্ত দেখতে চাই” টাইপ বয়ান দিয়েছে। “বিকল্প কে?” প্রশ্নও এনেছে। একই সাথে “বিএনপি জামায়াত দূরে থাক।” শুনতে হয়েছে। মাঝখানে ছোট একটা সময় আমরা এও দেখেছি, “এতদিন যেটা চাচ্ছিলেন সেটার পক্ষে ছিলাম। এখন যেটা চাচ্ছেন সেটার পক্ষে নেই।” এন্ড ফাইনালি “I feel cheated.”

এই সবকিছু তাকে করতে হয়েছে শুধুমাত্র কাল্ট হয়ে যাওয়ার কারণে। যদি এইটা কাল্ট না হতো এই মধ্যবিত্ত সরাসরি বলতো, “দুইদল কামড়াকামড়ি করে মরছে, আমার কী?” কিংবা এও বলতো, “আওয়ামীলীগ যায় করুক, অন্তত উন্নতি করেছে। বিএনপি জামায়াত তো এসে সিরিজ বোমা হামলা করে। জেএম্বি দিয়ে হামলা চালায়।” এছাড়া আশ্চর্য হতাম না যদি শুনতাম, “খোঁজ নিয়ে দেখেন, আবু সাঈদ শিবির করতো। ঐ সব রাজনীতি করা মানুষ। মরলে আমার কী?”

কিন্তু যখন দেখেছে মরছে ব্র্যাক-নসুর পোলাপান। যাদের আসলে ট্যাগ দিতে পারছেনা কিংবা আদারিং করতে পারছেনা কারণ যারা শহীদ হয়েছে ওদের সাথে একই ডিস্কর্ড সার্ভারে মধ্যবিত্ত গেম খেলতো। তখন মধ্যবিত্ত বাধ্য হয়েছে আন্দোলনকে কাল্ট হিসেবে সমাজে জায়গা দিতে, সমর্থন করতে।

এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ইভেন্ট ছিল প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের রাস্তায় নামা। ১৭-১৮ তারিখের আন্দোলনই মূলত মধ্যবিত্তকে সম্পৃক্ত করেছে। তাছাড়া ১০০ আবু সাঈদ কিংবা ৩০০ রিক্সাচালক-শ্রমিক-গার্মেন্টস কর্মী মরলেও মধ্যবিত্তের কিচ্ছু যায় আসেনা আনলেস সে দেখে তার IELTS কোর্সেমেট রাস্তায় পড়ে আছে।

ঠিক এই জায়গাতেই এসে আন্দোলনের পক্ষে কথা বলাকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। মধ্যবিত্ত কিন্তু দিনশেষে তার সমাজ, প্রতিবেশীকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়। সে যখন দেখছে প্রোফাইল লাল না হলে তাকে প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে তখনই সে বাধ্য হয়ে প্রোফাইল লাল করেছে। যদিও তার মনবাসনা রক্ত থেমে যাক আওয়ামীলীগও থাকুক টাইপের।

অর্থাৎ আমরা বুঝতে পারছি আমরা সফলভাবে আন্দোলনকে কাল্ট হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। এন্ড সেটার রেশ এখনো আছে। কিন্তু একটা সমস্যা রয়ে গেছে। এখন দেখবেন মধ্যবিত্ত আওয়ামীলীগের থেকে বিএনপি জামায়াতের ইতিহাস, অপরাধ নিয়ে বেশি আগ্রহী। আওয়ামীলীগের ১৫-১৬ বছরের সমস্ত অবিচার সে ইতোমধ্যে ভুলতে বসেছে। কিন্তু আন্দোলনে সমর্থন এবং একইসাথে আগেই ভালো ছিলাম তো থাকতে পারেনা। কীভাবে থাকছে?

ওয়েল, কাল্ট হিসেবে শুধু আন্দোলনে সমর্থন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কিন্তু আওয়ামীলীগ এবং তার সমস্ত বয়ান যেমন শেখ মুজিব, মুক্তিযুদ্ধকে সমস্ত পাবলিক স্পেস থেকে ডিস্মিস করে দেয়ার প্রবণতা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। যে সমস্যার কারণে আমরা আজকে দেখছি আন্দোলনে রাস্তায় নামা ছেলেও বলছে, “আওয়ামীলীগের সবার তো আর দোষ নাই।” কিংবা আদালত প্রাঙ্গণে জয় বাংলা স্লোগান। বা ৭ই মার্চের ভাষণের গুরত্ব অনেক, বাদ দেয়া ঠিক না।

এসমস্ত কিছু বিবেচনায় বলতে হয়, প্রতি-বিপ্লব কিংবা ফ্যাসিস্ট পুনর্বাসন কিভাবে হয় আমার জানা নাই। তবে সেটা যে বর্তমানে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ, চেতনা, শেখ মুজিব বন্দনা চলছে তার থেকে ভিন্ন কিছু আমার মনে হয়না। খুব দ্রুত কঠোরভাবে যদি সামাজিকভাবে আওয়ামী জড়িত সমস্ত বয়ান আমরা ডিস্মিস না করি এবং ‘২৪ কে ৭১ এর মতো করে স্থান না দেই তবে এই অভ্যুথানের সমস্ত আবেদন গুরত্ব হারাবে।

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ K.M. Asad/AFP via Getty Images